বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। ‘কথাসাহিত্য বিভাগে’ তার ‘মুসলমানমঙ্গল’ গ্রন্থের জন্য ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। রোববার (২৮ জানুয়ারি) নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার কথা জানান জাকির তালুকদার।
এ পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে ওই পোস্টে বিস্তারিত কিছু লিখেননি। পোস্টে অনেকে জানতে চান, কেন তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে জাকির তালুকদার বলেন, আজ সোমবার (২৯ জানুয়ারি) বিস্তারিত জানাবেন।
পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বরাবর চিঠি আজ সোমবার ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন জাকির তালুকদার। এই পোস্টের বিষয়ে লেখক লিখেছেন, পুরস্কার ফেরত, চিঠি ও সংযুক্তি।
চিঠিতে জাকির তালুকদার লেখেন, ২০১৪ সালে আমাকে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। আমি সেই সম্মান ও পুরস্কার গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই পুরস্কার আমার কাছে বোঝা মনে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান যদি সম্মানের আসন হারায়, তখন পুরস্কার তার মূল্য হারায়।
তিনি আরও লেখেন, সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, আমলাতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া বাংলা একাডেমির পরিচালনা পদ্ধতি সচেতন মানুষের আস্থা হারিয়েছে। কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন হয় না প্রায় আড়াই দশক যাবত। এই অবস্থায় পুরস্কারটি বহন করা আমার কাছে তাৎপর্যহীন মনে হচ্ছে। আমি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পুরস্কার ফেরত দিচ্ছি। সঙ্গে প্রাপ্ত অর্থমূল্যের চেক পাঠাচ্ছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাধিত হবো।
এ বিষয়ে সংযুক্তি হিসেবে ফেসবুক পোস্টে জাকির তালুকদার বলেন, ‘বাংলা একাডেমির সমস্যা এবং কার্যক্রম নিয়ে ১০ বছরে তিনজন মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। কখনো একা, কখনো আরও কয়েকজন লেখক-কবির উপস্থিতিতে। তাদের দুইজন প্রয়াত। একজন বর্তমানের ডিজি। তারা কেউ সমস্যাগুলোকে অযৌক্তিক বলেননি। কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়নি।
কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন খুব দরকার। গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু ২৫ বছর ধরে নির্বাচন দেওয়া হয় না। নির্বাচিত সদস্যের পক্ষে সম্ভব কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় জোরালো ভূমিকা রাখা। কিন্তু সেই সুযোগ বন্ধ করে রেখেছে বাংলা একাডেমি। পছন্দের লোকদের নিয়ে অ্যাডহক কমিটি তৈরি করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মহাপরিচালকসহ একাডেমির কর্মচারী-কর্মকর্তারাই সর্বেসর্বা। তারাই নির্ধারণ করেন একাডেমির আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে কাদের কাদের ডাকা হবে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই মানদণ্ড তাদের। সেই সঙ্গে তল্পিবাহকতাই বিশেষ গুণ। মেধা বা যোগ্যতা নয়।
প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনামী মেধাবীদের পাণ্ডুলিপি ফেলে রাখা হয়। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে তেমন পাণ্ডুলিপি চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করেছেন একাডেমির কর্মকর্তা। বছরে একবার বার্ষিক সাধারণ সভায় সদস্যরা কিছু দাবি বা সংস্কার প্রস্তাব করার সুযোগ পান। কোনো কোনো প্রস্তাব গৃহীতও হয়। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হলো কি না তা পরের বছরের সাধারণ সভায় জানানো হয় না। আসলে সেগুলো হিমঘরেই পড়ে থাকে।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয় কোন প্রক্রিয়ায় তা কেউ জানে না। তবে তারা দেশের সাহিত্যজগতের বরেণ্য মানুষ, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা অধিকাংশই বয়স্ক। দেশের প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে ওঠা লেখকদের সবার লেখা সম্পর্কে ধারণা থাকে না অনেকেরই। ফলে একাডেমির কয়েকজনের তোলা নামগুলোই পুরস্কার পায়।
গত কয়েক বছর ধরে পুরস্কারের একটি প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন কয়জন আমলা পাবেন পুরস্কার, বাংলা একাডেমির অন্তত একজন কর্মকর্তা পাবেন পুরস্কার, আর মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ পাবেন পুরস্কার। নিশ্চয়ই যেকোনো পেশার লেখক পুরস্কার পেতে পারেন। কিন্তু যখন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের চাইতে অধিকতর যোগ্য লেখককে বাদ দিয়ে পুরস্কারটা তাকে দেওয়া হয়, তখন তার সমালোচনা হবেই। অথচ একাডেমি কোনো সমালোচনায় কান দেয় না। আত্মসমালোচনা করে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে কোনো কবি বা লেখকের কাজের ক্ষেত্র বাদ দিয়ে তাকে অন্য ক্যাটেগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এগুলো সবই ভব্যতার ব্যত্যয়।’
১০ বছর আমি কী করেছি?
এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে জাকির তালুকদার নিজেই লেখেন, আলোচনা করেছি, সভা-সমাবেশে এসব কথা বলেছি, পত্রিকায় লিখেছি, ফেসবুকে লিখেছি অনবরত। প্রতিবাদের সর্বশেষ ধাপ পুরস্কার ফেরত দেয়া। আমার মতো একজন লেখকের এর চেয়ে বেশি আর কোনো সামর্থ্য নেই।
উল্লেখ্য, জাকির তালুকদারের বেড়ে উঠা নাটোরে। পাঠ নিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা ও গবেষণা বিভাগে কাজ করছেন জাকির তালুকদার। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পিতৃগণ, কুরসিনামা, মুসলমানমঙ্গল, কবি ও কামিনী, ছায়াবাস্তব, কল্পনা চাকমা ও রাজার সেপাই।