স্টাফ রিপোর্টারঃ ‘একতরফা’ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তাকে ‘অবৈধ-অগণতান্ত্রিক’ উল্লেখ করে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিএনপি এবং গণতন্ত্রের পক্ষে ৬৩টি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য আজকে অত্যন্ত স্পষ্ট, এই সরকারের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক যে ব্যবস্থাপনা সেটাকে জনগণ গত রোববার সরাসরি প্রত্যাখান করেছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে বৈধতা দেবার চেষ্টা করেছিল সেটি আজকে দেশে-বিদেশে সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আগামীতে তারা (ক্ষমতাসীনরা) যদি ক্ষমতার বলে, বন্দুকের নলে নির্ভর করে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রচেষ্টা বা দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু তারা বাংলাদেশের মানুষ শুধু নয়, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তারা অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক হিসেবেই বিবেচিত হবেন। সুতরাং জনগণের ইচ্ছায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম রাজপথে অব্যাহত রাখবে এবং সেই আন্দোলন-সংগ্রাম হবে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিন গতকাল সোমবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. মঈন খান বলেন, আমরা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আবার নতুন করে বলতে চাই, বিএনপির একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল, আমরা লগি-বৈঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, অন্যায়ভাবে কারো গায়ে হাত দেই না। আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বিএনপি জনগণের সঙ্গে থেকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে চায় এবং একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে, সেই ভোটের মাধ্যমে পরবর্তিতে এদেশের জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের একটি সরকার গঠিত হবে, কোনো ডামি প্রতিনিধি দিয়ে নয়।
তিনি বলেন, এদেশের মানুষ তাদের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বর্তমান স্বৈরাচারী যে অবস্থা সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। বিএনপি জনগণের দল, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং এই তাদেরকে সম্পৃক্ত করে আমরা রাজপথে নেমেছি জনগণের অধিকারের ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি এবং আগামীতেও রাজপথে থাকবো যতদিন না সত্যিকার অর্থে জনগণের অধিকার আমরা জনগণের হাতে তুলে দিতে পারব। এটাই এই বিএনপির প্রতিজ্ঞা।
৭ জানুয়ারি ভোট বর্জনের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে মঈন খান বলেন, ভোটাররা যে কাজটি করেছেন তারা বিদ্যমান আওয়ামী লীগের এই একদলীয় বাকশাল সরকারকে বয়কট করেছে। দেশের মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ভোট বর্জন করে জনগণ গণতন্ত্রকামী বিরোধী দলগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ তো অনেক হিউমার করে, আগামীতে যে সরকার গঠন করবে এই ভূয়া নির্বাচনের মাধ্যমে। সেটা আমরা এভাবে বলতে পারি, এই ধরনের ‘অব দ্যা ডমি, বাই দ্যা ডামি, ফ্রম দ্যা ডামি’। পরনির্ভরশীল ডামি সরকার নয়। জনগণ প্রত্যাশা করে সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি জনপ্রতিনিধিত্ব সরকার।
সারাদেশে গণসংযোগ কর্মসূচি:
দুই দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার ও বুধবার গণসংযোগ অব্যাহত রাখব। আমরা রাজপথে হাটে-ঘাটে মানুষের কাছে যাব, তাদের সাথে কথা বলব এবং তাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করব। গণসংযোগের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রের, মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার গণসচেতনতা সৃষ্টি করব। এরপর আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব।
নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কয়েকটি দেশ অভিনন্দন জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কূটনৈতিক শিষ্টাচারে বজায় রেখে কথা বলি, আওয়ামী লীগের মতো নয়। তিনটি দেশ সরকারের সঙ্গে দেখা করেছে অথবা সরকার একটি দেশকে নির্বাচনে জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকেও তারা ধন্যবাদ জানায়নি। তারা তাদের আচরণ এবং কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে না, তারা যার ওপর নির্ভর করে এই নির্বাচনে অন্যায় ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে তাতে কি দাঁড়াল?
ড. মঈন বলেন, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কিন্তু আমরা আমাদের চিন্তা-ধ্যানধারণা এবং বক্তব্য হচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি, মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং দেশে-বিদেশে যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, যারা আমাদের সঙ্গে থাকবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সরকার অবৈধ। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ৭ জানুয়ারি আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা কিভাবে ভোটারবিহীন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করছে। এই নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখান করেছে, তারা বর্জন করেছে।
ডামি নির্বাচন, ডামি অবজারভার:
আবদুল মঈন খান বলেন, ৭ তারিখ কোনো নির্বাচন হয়নি, ডামি নির্বাচন কমিশন, ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটার এবং সর্বশেষ ডামি অবজারভার নিয়ে একটা নাটক হয়েছে। এটা কোনো নির্বাচন না। তাদের যে নির্বাচনী অবজারভার যাদেরকে ভাড়া করে এনেছিলো তাদের মধ্যে একজন বিদেশী অবজারভার নিজেই বলেছেন, এটা কোনো নির্বাচন নয়। গণমাধ্যমেও তার বক্তব্যে এসেছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের ডামি নির্বাচন বর্জন সুস্পষ্টভাবে বিরোধী দলের দাবির প্রতি এদেশের গণমানুষের গণরায়। বাস্তবতা হচ্ছে যে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শোচনীয় ও নৈতিক পরাজয় হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের এই নাটকের প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ মারামারি করেছে, খুনাখুনিও হয়েছে। জোর করে ব্যালেটে সিল মারা আবার ভোট কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। সারা দেশে ৪০ হাজারে ওপর ভোট কেন্দ্র ছিলো। একটা বা চারটা ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে এটা হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই না। অবৈধ সরকার, গণপ্রতিনিধিত্ববিহীন সংসদ এবং বর্তমান মেরুদন্ডবিহীন নির্বাচন কমিশন দিয়ে বাংলাদেশে কোনোদিন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।
ভাড়াটিয়া অবজারভারও বলেছে ভোট হয়নি: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ একটি সরকার চাই এবং সেটার জন্য দরকার একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা হয়নি। ফলে এই নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখান করেছে এবং যে পরিমাণ ভোটের উপস্থিতি দেখানো হচ্ছে এটা যে ভূঁয়া, সকল মিডিয়া বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়া বলেছে, দেশ-বিদেশের ব্যক্তিরা সবাই বলেছেন। আর ভাড়াটিয়া অবজারভার পর্যবেক্ষকও বলেছেন।
তিনি বলেন, বিএনপিসহ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনরত সব রাজনৈতিক দলের দাবি হলো- অবিলম্বে ৭ জানুয়ারির এই ডামি নির্বাচন বাতিল করতে হবে, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে, রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং গুম-খুন-গায়েবি মামলা এবং পেশী শক্তি দিয়ে জনগণের আন্দোলন দমনকারী জুলুমবাজ সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থপাচার আর সিন্ডিকেট করে জনগণের সমস্ত সম্পদ ও অর্থ লুন্ঠনকারী এই সরকারকে বিদায় করতে হবে। এই দাবিতে আমরা জনগণ নিয়ে গণসংযোগ করব।
নজরুল ইসলাম বলেন, নিজেরা নিজেরা ডামি প্রার্থী বানিয়ে ৬৩জন ডামি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে। জাতীয় পার্টিকে ২৬টা আসন বন্টন করেছিলো তার মধ্যে ১১টাকে জিতছে, বাকিগুলো জিতেনি। ১৪ দলীয় জোটে যে কয়টি দিয়েছিলো তার মধ্যে কিছু হেরে গেছে। অবাক লাগে তারা (সরকার) বলছে যে, ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা যায় তাকে নমিনেশন দেয়া যায় না আরকি। এখন দেখা যাচ্ছে যে, ক্রেন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কিছু লোককে তোলার তারা জয় পেয়েছে। আবার কাউকে কাউকে ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হয়নি, তারা পরাজিত হয়েছে। এটা কোনো নির্বাচন হলো? গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবিধান এগুলো নিয়ে রসিকতা করার কোনো অধিকার কারো নেই। সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও ছিলেন।