বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছে আদালত বর্জন কর্মসূচি

স্টাফ রিপোর্টারঃ  সরকারের পদত্যাগ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিচারের নামে অবিচার বন্ধের দাবিতে বিএনপির চলমান অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন সারাদেশের আইনজীবীরা। এর ফলে আদালতগুলোতে আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারিদের উপস্থিতি ছিলো তুলনামূলকভাবে কম। আইনজীবীরা আদালতে না যাওয়ায় পূর্ব ধার্যকৃত তারিখ অনুযায়ী গতকাল বিচার কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। দুর্ভোগে পড়েন দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিচারপ্রার্থীরা।

গতকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বারের আদালতে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়। তবে সরকারপন্থি আইনজীবীরা দাবি করছেন, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদের ডাকা বর্জন কর্মসূচিতে সাধারণ আইনজীবীরা সাড়া দেননি। এ কারণে উপস্থিতি কম হলেও অধিকাংশ আদালতে স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

 

আদালত সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ডাকে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা গতকাল থেকে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন। গতকাল সকাল থেকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এ কর্মসূচি পালন শুরু করেন। এ সময় ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নিয়ে সরকার এবং নির্বাচন বিরোধী শ্লোগান দেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আইনজীবীগণ। ঢাকা বারের বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আদালত বর্জনের কর্মসূচি পালন করছি। কোনো কোনো এজলাসে উপস্থিত থাকলেও মামলার শুনানিতে আমরা অংশ নিচ্ছি না।

গতকাল ঢাকার অধস্তন আদালতে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেছেন। আদালত বর্জনের পরপর তারা বিক্ষোভ মিছিলও বের করেন। মিছিলটি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রদক্ষিণ করে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় আইনজীবীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন রকম শ্লোগান দেন। মিছিলে ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো: ইকবাল হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোরশেদ মিয়া আলম, ওমর ফারুক ফারুকী, মহসিন মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, এস এম কামাল প্রমুখ অংশ নেন।

গত ২৭ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ১ থেকে ৭ জানুয়ারি সারাদেশের সব আদালত বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

আদালত বর্জন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামপন্থি আইনজীবী সংগঠন ‘বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল’র যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই সরকার ন্যাক্কারজনকভাবে আদালতগুলোতে হস্তক্ষেপ করে বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে। নেতাকর্মীদের সাজা দিতে রাত পর্যন্ত সাক্ষ্য-গ্রহণের নজির স্থাপন করেছে। বিচার প্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসবের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে আমরা আদালত বর্জন করছি।

এদিকে ‘জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম’ আহূত আদালত বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলা বারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল ইংরেজি বছরের প্রথম দিন সকাল ১১টা থেকে তারা আদালত বর্জন শুরু করেন তারা। এর ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে আইনজীবীরা শান্তিপূর্ণভাবে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় আব্দুল মান্নান বলেন, এই সরকারের অধীনে কেউই আদালতে ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না। সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই কেন্দ্রীয় বিএনপির কর্মসূচির অংশ হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে আমরা আজ থেকে আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছি। আমরা কেউ আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবো না। তিনি বলেন, এই বারে আইনজীবী ফোরামের অন্তত ৩৫০ আইনজীবী রয়েছেন। তারা কেউ আদালতে যাবেন না।

ঠাকুরগাঁওয়ে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিচারের নামে অবিচার বন্ধের দাবিতে গতকাল ১ জানুয়ারি থেকে আগামী ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালত বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

গতকাল সকালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ‘ঠাকুরগাঁও জজ কোর্ট’ আইনজীবীদের ব্যানারে এ আদালত বর্জনের পক্ষে মিছিল বের করেন নেতৃবৃন্দ। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনতাজুল হক-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভায় বক্তারা বলেন, আগামী ৭ জানুয়ারি সরকার আরেকটি নীলনকশার পাতানো ডামি নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে। কথিত নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য সরকারি দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী, বিদ্রোহী প্রার্থী, অনুগত প্রার্থীসহ হরেক রকম প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কারা ডামি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে তাও ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ, ‘ডামি নির্বাচন’ বর্জন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই আমাদের এ কর্মসূচি।

সিলেট আদালতে গতকাল বর্জন কর্মসূচি পালন করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়। বর্জন কর্মসূচি চলাকালে এমরান আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান অনির্বাচিত সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নিজেদের ইচ্ছেমাফিক পরিচালনা করছে। বিনা অপরাধে হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। তাদের এই স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে এবং আইন-আদালতকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করার দাবীতে আমরা সপ্তাহব্যাপি আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করছি। সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির ৩নং বারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেট ইউনিট ও ইউনাইটেড ল’ ইয়ার্স ফ্রন্ট সিলেট শাখার যৌথ উদ্যোগে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো: আলীম উদ্দিন, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সিলেট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল আহমদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মো: আনোয়ার হোসেন, অ্যাডভোকেট মো: মুহিবুর রহমান, অ্যাডভোকেট মো: ফজলুল হক সেলিমসহ শতাধিক আইনজীবী অংশ নেন।

এদিকে নোয়াখালি আইনজীবী সমিতি, খুলনা আইনজীবী সমিতি, বগুড়া আইনজীবী সমিতি, কুমিল্লা আইনজীবী সমিতি, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি, যশোর আইনজীবী সমিতিসহ সারাদেশের জেলা বারের বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীগণও অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহের আহূত ‘অসহযোগ আন্দোলন’র অংশ হিসেবে গত ২৭ ডিসেম্বর সারা দেশে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। বিচারিক আদালত খোলার প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেন জামায়াতে ইসলামী সমর্থক ‘বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল’। যদিও সরকার সমর্থক সুপ্রিম কোর্ট বার এই কর্মসূচিকে সরাসরি বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *