জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন করতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রতি সন্ধ্যায় ‘কোর কমিটি’ বৈঠকে বসত। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাসংস্থার সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকতেন। সেখানেই মূলত আন্দোলন দমনের নীল নকশা তৈরি হতো।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরচারী হাসিনা মনে করেছিল, ভারী অস্ত্রের ব্যবহার হলে সাধারণ আন্দোলনকারীরা ভয়ে ঘরে ফিরে যাবেন। কিন্তু তার সেই চেষ্টাও পরে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। বরং, ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নিহত হলে আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভ দমনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোর কমিটি নামে এক কমিটির সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন। সন্ধ্যায় তার বাসভবনে এই বৈঠক হতো। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক; বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির সাবেক মহাপরিচালক; ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও এনটিএমসি’র প্রধান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার। এছাড়া ২০ জুলাই থেকে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র জেনারেলও অংশ নেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনা এবং তার দপ্তরের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আন্দোলন দমনের যোগাযোগ রাখতেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ছাত্রলীগ সমর্থকদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে উসকানি দেয়। এ বিষয়ে একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওএইচসিএইচআরকে বলেন, ওবায়দুল কাদেরের আহ্বানের ভিত্তিতে ছাত্রলীগ বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু যা ঘটেছিল তা অপ্রত্যাশিত ছিল, ছাত্ররা প্রতিহত করে।
আরেক সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনে করেছিলেন, যদি তারা তাদের ভারী ইউনিট মোতায়েন করে তবে কেবল লড়াকুরাই রাস্তায় থাকবে অন্যরা বাড়ি ফিরে যাবে। ফলে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ দমনে পুলিশ একপর্যায়ে প্রাণঘাতী ধাতব গুলি ভর্তি শটগান ব্যবহার করে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ওই সময় সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। এতে শুধু ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ কমপক্ষে ছয়জন নিহত হন।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কমপ্লিট শাটডাউন-এর ডাক দিলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে দায়িত্ব দেন। তবে, সেই পর্যায়ে ছাত্ররা আর আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কারণ ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার কারণে তারা সরকারের সৎ বিশ্বাসের ওপর সন্দেহ পোষণ করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ জুলাই থেকে সাধারণ জনগণও রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীরা প্রধান সড়কগুলোতে যান চলাচল ব্যাহত করার চেষ্টা করে। এই পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনী একটি প্রাণঘাতী শক্তির দৃষ্টান্তে রূপান্তরিত হয়েছিল। তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে রাইফেল, পিস্তল ও শটগান ব্যবহার করে। অনেক জায়গায় হত্যাকাণ্ড ঘটায়। একই সঙ্গে আহতদের চিকিৎসাসেবাও বাধাগ্রস্ত করে। ওইদিন সন্ধ্যায় সরকার বিজিবিকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেয়। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধ ঘোষণা করে। সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েও অস্থিরতা দমন করতে পারেনি তারা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১০ জুলাই থেকে নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি র্যাব মোতায়েন করা হয়েছিল। আন্দোলনের সময়, তারা সারা দেশে ১৫টি ব্যাটালিয়নের সবকটি মোতায়েন করেছিল। ১৫ জুলাই থেকে কমপক্ষে ১৪টি আনসার/ভিডিপি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছিল। ১৬ জুলাই থেকে, বিজিবিও মোতায়েন করা হয়েছিল। সারা দেশে ৫৮টি স্থানে প্রায় ৪,০০০ সীমান্তরক্ষী মোতায়েন ছিল। ওই দিন থেকে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে ছয়টি সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তারা শটগান ও রাইফেল ব্যবহার করেছিল। তথ্য সংগ্রহের জন্য ডিজিএফআইয়ের প্রায় ১১০ জন কর্মকর্তা এবং ৯০০ জন মাঠকর্মী মোতায়েন করা হয়েছিল।