সম্প্রতি বাংলাদেশে হওয়া গুরুতর নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত ও জবাবদিহিতার জন্য একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া থাকা উচিৎ বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো একটি চিঠিতে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থাটি। এছাড়া বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্ত করার দাবিও জানানো হয় চিঠিতে।
গত সোমবার (২৬ আগস্ট) সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত চিঠিটি প্রকাশ করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও কাউন্সিলে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও জানায়, গত ১৫ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনে বলপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি স্বাধীন অভ্যন্তরীণ তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা দরকার। এ জন্য ওএইচসিএইচআর এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করা উচিত বলে মনে করে সংস্থাটি। যাতে এটির স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা যায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জেনেভায় জাতিসংঘের উপপরিচালক লুসি ম্যাককার্নান বলেন, গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব অনেক। আগের সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটি স্বাধীন অভ্যন্তরীণ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন চাওয়া উচিত বলেও জানান তিনি।
চিঠিতে বলা হয়, জরুরিভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেসামরিক তদারকি আনা দরকার। এছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ভেঙে ফেলা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও অবমাননাকর আইন সংশোধন করা উচিত।
তাছাড়াও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনার পতনের আগে সংগঠিত বিক্ষোভের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দমন-পীড়ন করা হয়েছিল। গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে ৪৪০ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
এই হতাহতের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র ও যুব গোষ্ঠীর দায়ী। ৫ আগস্টের পরেও আনুমানিক আরও ২৫০ জন মারা গেছে। এদের বেশিরভাগই শেখ হাসিনার সমর্থকদের সহিংস প্রতিশোধের শিকার বলেও চিঠিতে বলা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এমন কর্মকর্তাদের বদলি করছে, যারা রাজনৈতিক পক্ষপাতের সাথে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভের পর তিনি পদত্যাগ করেছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর আইন প্রয়োগকারীরা ভেঙে পড়েছিল। হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংসতার ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, বেশিরভাগ থানা এখন কাজ করছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, তবে মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা ও সমর্থকদের নির্বিচারে গ্রেফতার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনি পরামর্শের যথাযথ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে পূর্ববর্তী সরকারের ন্যায় অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি করছে। তবে মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাংবাদিকসহ সমর্থকদের গ্রেফতার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনি পরামর্শের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে আগের সরকারের মতো আচরণ করছে।
অবশ্য ইউনূস প্রশাসন সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, সহিংসতা প্রশমিত করার জন্য কাজ করেছে এবং বিক্ষোভ দমন করতে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য দায়ীদের তদন্ত ও বিচার করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া আটক রাজনৈতিক বন্দীদের দ্রুত মুক্তি দিয়েছে, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হতে যাচ্ছে এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ৭০০ টিরও বেশি মামলা তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তাই বিভক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রতি তার অঙ্গীকারগুলি কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জুলাই ও আগস্টের সহিংস ঘটনা এবং এর মূল কারণগুলো জবাবদিহির আওতায় আনতে তথ্য-প্রমাণ যাচাই, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য এবং বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত একটি স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ওএইচসিএইচআরকে নিয়মিত প্রতিবেদন দেয়া উচিৎ বলেও উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক সংস্কার ও কেউ যাতে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেটি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
চিঠিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে সকল প্রতিষ্ঠান, সুরক্ষা খাত এবং বিচার ও আইনি ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয় উল্লেখ করে বলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর শক্তিশালী মানবাধিকার প্রশিক্ষণ প্রটোকল বাস্তবায়ন করা। একইসঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের দায়মুক্তি দেয় এমন আইন বাতিল করা।
জাতিসংঘের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের কষ্টার্জিত অগ্রগতি সহজেই হারিয়ে যেতে পারে এমন শঙ্কা জানিয়ে চিঠিতে ম্যাককার্নান বলেন, গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের কষ্টার্জিত অগ্রগতি সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। তাই জাতিসংঘ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত বাংলাদেশের সত্যানুসন্ধান ও জবাবদিহিতার পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে বিনিয়োগ করে সব বাংলাদেশির প্রতি তাদের সমর্থন প্রদর্শন করা।