জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিপক্ষে মত দিয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল।
শনিবার বিকালে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দলগুলোর পক্ষ থেকে এমন মতামত দেওয়া হয়।
এতে ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে বড় দলগুলো ঐক্যের ওপর জোর দেন। এছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বেশ কয়েকটি দলের নেতারা তাদের নিবন্ধনও বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এদিন সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এর মাধ্যমে পথচলা শুরু করল এ কমিশন। বেলা তিনটা থেকে প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদষ্টো অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও কয়েকটি সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। তবে আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটে থাকা কোনো দল ও জাতীয় পার্টিকে এ বৈঠকে ডাকা হয়নি।
বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রক্রিয়া কী হবে সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা। মূলত এ বৈঠককে আমরা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছি। এখানে ২৭টির বেশি দল ও জোট মিলিয়ে একশ জনের বেশি নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ৩২ জন কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে যেটি স্পষ্ট হয়েছে, সেটা হলো তারা মনে করেন জাতীয় ঐক্য রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা দৃঢ়চিত্ত। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়াকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে এবং অংশগ্রহণ করবেন। প্রধান উপদষ্টো ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান বলেছেন, ‘ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দল হিসাবে, সমাজের নাগরিক হিসাবে, মানুষ হিসাবে এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়া আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।’
আলী রীয়াজ বলেন, আমরা আশা করছি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ এখন শুরু হবে। আমরা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব, জোটগতভাবেও কথা বলব এবং একপর্যায় হয়তো আশা করছি, সবাইকে একত্রিত করে আমরা আবার ফিরে আসব। এই প্রক্রিয়ায় আমরা দীর্ঘসূত্রতা করতে চাই না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটা করতে পারব আশা করছি। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আমাদের অনুরোধ করা হয়েছে, যেসব প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর হার্ড কপি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। সর্বোপরি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কারও কোনোরকম দ্বিধার সুযোগ নেই। সে আলোকে খুব দ্রুত আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে অগ্রসর হতে চাই। যতটুকু কাজ হয়েছে, তা সূচনামাত্র।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠকে এই সংলাপে কতদিন লাগতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, এই কমিশনের মেয়াদ ৬ মাস। সেক্ষেত্রে কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাই। যেহেতু ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও আমরা দিয়েছি। সেগুলো পর্যালোচনা করার জন্য তাদের দিতে হবে। আমরা চাই, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। কেননা এই সংস্কার কর্মসূচিগুলো অগ্রসর হওয়া এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার যাতে আমরা নির্বাচনের পথে এগোতে পারি।
বুধবার প্রধান উপদষ্টো অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহসভাপতি করা হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। বৈঠকে এ সংস্কার কমিশনেরর সবাই উপস্থিত ছিলেন।
ন্যূনতম সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন হবে আশা বিএনপির : বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশা করব, খুব দ্রুত এই সংস্কারের বিষয়ে নূ্যনতম যে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেটার ওপর ভিত্তি করে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে হতে হবে বলে আবারও বিএনপির অবস্থানের কথা বৈঠকে তারা তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে। তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।’ মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদষ্টো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করলেন। এই বৈঠকে তিনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলেছেন। দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কারের যে প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন কমিশন জমা দিয়েছে, সেগুলোর ওপর আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এ নিয়ে কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেটাই মূল কথা। আজ প্রাথমিক আলোচনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কথা বলেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রথম বৈঠকটি মূলত পরিচিতিমূলক, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ও গঠনমূলক আলোচনা হয়নি।
সংস্কারের সব ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবে জামায়াত : সব ইতিবাচক সদ্ধিান্তকে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানাবে জানিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা বলেছি এই সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত সদ্ধিানে্তর পরে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। তারা আমাদেরকে সংস্কারের রিপোর্ট বই দেবেন, সেই বই পর্যালোচনা করে জামায়াতে ইসলামী এবং সরকারের যে টিম রয়েছে তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক হবে। সেখানে আলোচনা করে মূল সদ্ধিান্ত জানাব। তাহের বলেন, আমরা বলেছি যে সংস্কারটা প্রয়োজন তাতে আমরা একমত। এবং যথাসময়ে নির্বাচন দিতে হবে।
আ.লীগকে নিষদ্ধি ও দলের নিবন্ধন বাতিল চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি : জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, আমরা বলেছি টেস্ট ম্যাচের মাধ্যমে যেতে হবে, যেখানে ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের অসমাপ্ত কাজগুলো রয়েছে সেগুলো সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে সমাপ্ত করতে হবে। মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকার ও সংস্কার কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-নাগরিক সদ্ধিান্ত দিয়েছে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক। আজকে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হয়েছি বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে যায়, একইভাবে আওয়ামী লীগও অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে। আমরা সরকারকে আইনি উদ্যোগ নিয়ে নিষদ্ধি করে এবং পরবর্তী কোনো প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ যেন ফাংশন না করে সেটা বলেছি। প্রথম ধাপ হিসাবে তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি করেছি। এটা হবে প্রাতিষ্ঠানিক সদ্ধিান্ত। আমরা আমাদের জায়গা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট করেছি, যে নেৌকা ডুবে গেছে সেটি বাংলাদেশে আর কখনোই ভাসবে না।
আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন না উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আমরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছি। যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে জাতীয় নাগরিক কমিটি অথবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বলেন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে হয় ওই ব্যক্তি অথবা প্ল্যাটফরম তাদের নামে আমাদের প্রতিবাদ আবার শুরু হবে।
অন্যান্য দল : গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, চরিত্রের দিক থেকে সরকার হচ্ছে দলনিরপেক্ষ একটি অন্তর্র্বর্তী সরকার। বিশেষ কোনো দল, মতাদর্শের প্রতি সরকারের পক্ষপাত থাকার কথা নয়। সুতরাং সরকার নিরপেক্ষ চরিত্র, বৈশষ্ট্যি অক্ষুণ্ন রাখবে এবং রাজনৈতিক দল, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন সবাইকে আস্থায় নিয়ে, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বোঝাপড়ায় আসতে পারব। নির্বাচনসহ পরবর্তী গণতানি্ত্রক উত্তরণের ব্যাপারে আমরা সদ্ধিানে্ত আসতে পারব। বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যাপারে একটা কথা বৈঠকে এসেছে। দেশে যে রাজনৈতিক সমস্যা, সামনে যে নির্বাচন ও সংস্কার সে বিষয়ে ঐকমত্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচনের আগে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় তাহলে মানুষের অগ্রাধিকার বদলে যাবে। তাতে অনেক নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাই না। আগামীতে সিরিজ মিটিং হবে, আমাদের জানানো হবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আছে ঠিকই, কিন্তু কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হয়নি। এ রকম কর্তৃত্বহীন অবস্থায় যে কোনো নির্বাচন হবে বিপজ্জনক। তিনি বলেন, এই সরকারের সঠিক কর্তৃত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরকম একটা ভঙ্গুর অবস্থায় কীভাবে একটি নির্বাচন করবেন। কর্তৃত্ব এবং সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে এ নির্বাচন হতে পারে খারাপ একটা নির্বাচন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু কথা বলেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এই কথা বলেছে যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে মোটামুটি সবাই একমত।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এলডিপি, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস, ডেমোক্রেটিক লেফট ইউনিটি, লেবার পার্টি, বাংলাদেশে জাসদ, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণফোরাম, আমজনতার দল, লেফট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।