আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র গতকাল বলেছেন, তাদের বাহিনী গাজা আক্রমণের একটি নতুন এবং কম তীব্র পর্যায় শুরু করেছে। ব্যাপক আক্রমণে বেসামরিক নাগরিকদের লাগাতার মৃত্যুর মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে আক্রমণ প্রত্যাহারে চাপের কারণে কয়েক সপ্তাহ শিথিল আক্রমণের পর এ পর্যায় শুরু করা হয়েছে। মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডএম ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ইসরাইলি অভিযান ইতোমধ্যেই এমন একটি অভিযানে রূপান্তর শুরু করেছে যাতে কম স্থলসেনা এবং বিমান হামলা জড়িত হবে। অ্যাডমিরাল হাগারি নিউইয়র্ক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যুদ্ধ একটি পর্যায় পরিবর্তন করেছে’। ‘তবে রূপান্তর কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই হবে’ বলে তিনি যোগ করেছেন। ‘এটি নাটকীয় ঘোষণা সম্পর্কে নয়’।
গাজা সংঘাতকে বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপান্তরিত করা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের মাল্টিস্টপ সফরের অংশ হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি জে ব্লিঙ্কেন ইসরাইলে আসার কয়েক ঘণ্টা আগে তার মন্তব্য এসেছে। এডমিরাল হাগারি দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার আনা একটি মামলার শুনানি শুরুর আশা করার কয়েক দিন আগেও বক্তৃতা করেন যা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে গণহত্যা করার জন্য অভিযুক্ত করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে যা জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ। ইসরাইল দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে এ অঞ্চলে এ আক্রমণ শুরু করে।
কিন্তু এটা স্পষ্ট ছিল না যে, ইসরাইলের আক্রমণের নতুন পর্ব গাজার বেসামরিকদের জন্য কম বিপজ্জনক হবে কি না। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখনও বিমান হামলায় প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর খবর দিচ্ছেন এবং হামাস সামরিক অবকাঠামো লুকানোর জন্য চিকিৎসা সুবিধা ব্যবহার করার অভিযোগ এনে ইসরাইলি বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলায় অঞ্চলটির প্রধান হাসপাতালগুলো সেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
এডমিরাল হাগারি বলেছেন যে, ইসরাইল গাজায় সৈন্য সংখ্যা কমাতে থাকবে এ মাসে শুরু হওয়া একটি প্রক্রিয়া। যেহেতু ইসরাইলি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তারা উত্তর গাজায় হামাসের সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করেছে, অ্যাডমিরাল হাগারি বলেছেন, উত্তর গাজায় অভিযানের তীব্রতা ইতোমধ্যেই হ্রাস পেতে শুরু করেছে, কারণ সামরিক বাহিনী ব্যাপক কৌশলের পরিবর্তে সেখানে আরো টার্গেটেড অভিযান পরিচালনার দিকে চলে গেছে। তিনি বলেন যে, ইসরাইল এখন গ্রুপের দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় দুর্গের দিকে মনোনিবেশ করবে, বিশেষ করে খান ইউনিস এবং দেইর আল বালাহ শহরের চারপাশে।
তিনি বলেন, ইসরাইল গাজায় বাস্তুচ্যুত লোকদের বাড়িতে তাঁবুসহ আরও মানবিক সাহায্যের অনুমতি দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে যে, ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের বিমান হামলা এবং স্থল অভিযানের মধ্যে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ বা প্রায় ১৯ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাধ্য হয়েছে।
অ্যাডমিরাল হাগারি ইসরাইল গণহত্যা করছে তা অস্বীকার করে বলেছেন যে, ইসরাইল বেসামরিক মৃত্যু এড়াতে সমস্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে এবং গাজায় ত্রাণ বিতরণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। অ্যাডমিরাল বলেন, হামাস বেসামরিক এলাকায় তার সামরিক অবকাঠামো এম্বেড করে বেসামরিক নাগরিকদের বিপন্ন করেছে। তিনি যোগ করেছেন যে, আদালতের এর পরিবর্তে ৭ অক্টোবর যুদ্ধ কীভাবে শুরু হয়েছিল তার ওপর ফোকাস করা উচিত, যখন ইসরাইলে হামাসের নেতৃত্বাধীন অভিযানে প্রায় ১২০০ জন নিহত হয়েছিল। ইসরাইলি কর্মকর্তাদের মতে, ওই ঘটনাই ইসরাইলকে বিমান হামলা এবং আক্রমণের সাথে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্ররোচিত করেছিল।
আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের পরিস্থিতি ‘বিপর্যয়কর’ : তীব্র আক্রমণের মুখে গাজার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে আল আকসা মার্টিরস হাসপাতাল থেকে কয়েকশ’ রোগী ও স্টাফ অজ্ঞাত স্থানে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ বলেছে, হাসপাতালের প্রায় ৬০০ রোগীসহ বেশির ভাগ মেডিকেল স্টাফ অজ্ঞাত স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা কোথায় আছেন এ বিষয়ে কেউ কোনো খবর জানেন না। উভয় সংস্থাই বলছে, হাসপাতালটি চলছে শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ স্টাফ দিয়ে। কয়েক মিনিট পর পর সেখানে রোগী আসছেন। গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ বোমা হামলায় আহতদের প্রতিক্ষণ নেয়া হচ্ছে সেখানে। কিন্তু সীমিত সংখ্যক স্টাফ দিয়ে তাদের সেবা দেয়া অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। ফলে এক বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয়কের অফিসের কিছু স্টাফ রোববার দিয়েইর আল-বালাহ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন। এটিই সেখানে সচল থাকা একমাত্র হাসপাতাল। সেখানে তারা দেখতে পেয়েছেন তীব্র বোমা হামলায় আহতরা আল আকসায় চিকিৎসা সহায়তার জন্য ভিড় করছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রিপোর্টে বলেছে, ৫ থেকে ৭ জানুয়ারির মধ্যে ২২৫ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং ২৯৬ জনকে আহত করেছে ইসরাইল।
হাসপাতালটির পরিচালক বলেছেন, তীব্র শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ এবং চলমান উদ্ধার অভিযানের কারণে স্থানীয় বেশির ভাগ স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রায় ৬০০ রোগী অজ্ঞাত স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা সিন ক্যাসি বলেন, কয়েক মিনিট পর পরই নতুন নতুন রোগী আসছেন হাসপাতালে। তাদেরকে চিকিৎসা দিতে আছেন মাত্র ৫ জন ডাক্তার। শত শত রোগীকে সেবা দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাস্তবেই পরিস্থিতি নৈরাজ্যকর। হাসপাতালের পরিচালক আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন যাতে তার হাসপাতালটিকে সুরক্ষিত রাখা হয়, যদিও বেশির ভাগ স্টাফ সরে গেছেন।
ইসরাইলি সেনারা তাদের অভিযান জোরালো করার ফলে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং মেডিকেল এইড ফর প্যালেস্টাইন বলেছে, ওই হাসপাতালে কর্মরত তাদের জরুরি মেডিকেল টিমকে সরে যেতে এবং কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে বলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস বলেছেন, হাসপাতালের করিডোর রক্তমাখা। তার ওপর বিশৃংখল অবস্থায় পড়ে থাকা সব বয়সী রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে দেখেছেন তার স্টাফরা।
তিনি বলেন, গাজার মধ্য এলাকায় এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল হলো আল আকসা। এখনও তা সচল ও সুরক্ষিত আছে। সেখানে জীবনরক্ষাকারী সেবা দেয়া হচ্ছে। এরপর যদি সেখানে আরও ক্ষতি করা হয় তাহলে তা আর সচল থাকতে পারবে না। সেখানে আরও ক্ষতি করা হবে মানবাধিকারের প্রতি নৈতিক দুর্ভোগের বিষয়। ওদিকে ক্যাসি বলেছেন, তার টিম ওই হাসপাতালে কয়েক হাজার রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। এছাড়া মানসিক ক্ষত আছে অনেকের। রোববার ওই হাসপাতালে কিছু মেডিকেল সরঞ্জাম ও বেড দিয়েছেন তারা।
যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরাইলকে চাপ দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে : আবদুল্লাহ
জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে সতর্ক করেছেন যে, গাজায় যুদ্ধ চলতে থাকলে ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ হবে। গত রোববার আম্মানে এক বৈঠককালে জর্ডানের নেতা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন যে, ‘স্ট্রিপের মর্মান্তিক মানবিক সংকটের অবসান হওয়া দরকার’। চলমান ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে একটি যৌথ মিশনের বিষয়ে আরব নেতাদের সাথে কথা বলতে ব্লিঙ্কেন এ অঞ্চলে ফিরে এসেছেন। গ্রীস, তুরস্ক, জর্ডান এবং কাতারে দ্রুত রাউন্ড সফরের পর ব্লিঙ্কেন ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ার আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদী আরব, পশ্চিম তীর, মিসর এবং ইসরাইলে বিরতি নিয়ে এ সপ্তাহের শেষের দিকে তার সফর চালিয়ে যাবেন।
রোববার কাতারের দোহায় আমেরিকার শীর্ষ কূটনীতিক কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক সংবাদ সম্মেলনের সময় বলেন, যুদ্ধের পরে ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের অন্যত্র পুনর্বাসনের জন্য মুষ্টিমেয় কিছু ইসরাইলি মন্ত্রীর সমর্থন করা পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করে।
মধ্যপ্রাচ্য কূটনৈতিক মিশনে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি। তাছাড়া আম্মানে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির গুদাম পরিদর্শন করেন ব্লিঙ্কেন। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত তিন মাসে চতুর্থবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফর করলেন ব্লিঙ্কেন। এ সফরে বেসামরিক নাগরিক হত্যা, গাজায় মানবিক সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো এবং সংঘাত পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। জানা গেছে, জর্ডানের রাজধানীতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আঞ্চলিক সমন্বয় গুদামও পরিদর্শন করেছেন ব্লিঙ্কেন। এখানে গাজার জন্য ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো রাখা হয়েছে। এই সব ট্রাক রাফাহ ও কেরেম শালোম ক্রসিং দিয়ে গাজায় ঢুকবে। টেকসই শান্তি ও নিরাপত্তা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে শনিবার গ্রিসে ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, এটি বাস্তবায়নের জন্য মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। তার আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি।
গাজার ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত : জাতিসংঘ : গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা ভূখণ্ড জুড়ে ১৯ লাখ মানুষ (বা জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের বেশি) কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলেছে, ‘গত ২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি গাজা উপত্যকার পাঁচটি গভর্নরেট জুড়ে ১৫৫টি ইউএনআরডব্লিউএ স্থাপনাগুলোতে আশ্রয় নিয়ে আছে, যার মধ্যে উত্তর এবং গাজা সিটিসহ ১ লাখ ৬০ হাজার এবং প্রায় ৫ লাখ এসব ইনস্টলেশনের কাছাকাছি রয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছে’। ৬ জানুয়ারি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় কমপক্ষে ২২,৮৩৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু বলে জানা গেছে। আরো ৫৮ হাজার ৪১৬ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র : আল-জাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও ডব্লিউএইচও।